মোহাম্মদ শরিফুল আলম চৌধুরী : ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগকে ‘ভাই লীগ ও এমপি লীগে’র বলয় থেকে রক্ষা করতে কাজ শুরু হয়েছে। দলের জেলা উপজেলার ত্যাগী নির্যাতিতরা এক প্ল্যাটফর্মে এসে কমিটির এ কার্যক্রম গ্রহণ করার কাজ শুরু করেছেন। ইতোমধ্যে এ বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন জেলা উপজেলার সাবেক দায়িত্বপ্রাপ্ত মুরাদনগরের নেতারা। তৃণমূল পর্যায়ে কমিটি করার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় কমিটির কতিপয় নেতা হস্তক্ষেপের কারনেই ‘ভাই লীগ ও এমপি লীগ’ থেকে আর সহজেই পরিত্রাণ পাবে না এমনটাই মনে করেন ঐক্যের মাধ্যমে গঠিত ‘মুরাদনগর উপজেলা বঞ্চিত আওয়ামীলীগ’ নামক নতুন কমিটির অনেক সিনিয়র নেতা।
জানা যায়, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ টানা তিনবার সরকার গঠন করেছে। টানা ক্ষমতায় থাকার ফলে তৃণমূল আওয়ামী লীগের এক প্রকার বলয় সৃষ্টি হয়েছে। তার নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্থানীয় এমপি ও তার ছত্রছায়ায় থাকা ভাই লীগরা। ‘এমপি লীগ ও ভাইলীগে’র কারণে তৃণমূলের ত্যাগী নেতাকর্মী দল থেকে অনেকই বঞ্চিত হয়েছেন। ত্যাগীরা মনে করছেন দেশের রাজনীতি এখন আর রাজনীতিবিদদের হাতে নেই।
রাজনীতি চলে গেছে ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, জামাত বিএনপি ও মুসলীমলীগের দোসরদের হাতে। বর্তমান এমপিদের বেশিরভাগ ২ মেয়াদে থাকায় কাজের প্রতি তেমন একটা আগ্রহ ভাটা, নেতাকর্মীদের পাশ কাটিয়ে নিজের পছন্দের লোকজনকে প্রাধান্য দেয়াসহ নানা অনিয়ম, বিলাসিতায়, স্বজনপ্রীতিসহ নয়ছয় গ্যাড়াকলে জড়িয়ে পড়ায় প্রায় এমপির গ্রহণযোগ্যতা এখন প্রশ্নের সম্মুখীন।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে ত্যাগীরা মাঠে থাকলেও বর্তমানে দলের তেমন সঙ্কট না থাকায় স্থানীয় এমপিদের ঘিরে কিছু হাইব্রিড নেতাদের উপস্থিতি দেখা যায়। অথচ অতীতে দলের বিভিন্ন সঙ্কটময় সময় তাদের দেখা যায়নি। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এসব হাইব্রিড নেতাদের আনাঘোনা বেশি দেখা যায়। বড় নেতা বা ছোট-মাঝারি নেতার পোস্টার ও ব্যানারে হাইব্রিড নেতারা নিজের ছবি ঢাউস করে দিয়ে দলীয় প্রার্থীর জন্য ভোট চান বিভিন্ন সময়।
কিন্তু ত্যাগীরা তা করতে পারেন না। এমন অনেক নেতাই আছেন যারা নিজেরই চলতে কষ্ট হয়। নেতাদের জন্য ব্যানার কিংবা পোস্টার করতে পারেন না। সেদিক থেকে তারা পিছিয়ে থাকেন সব সময়। যা ফল ভোগ করতে হয় নতুন কমিটি গঠনের সময়। সেখানে ত্যাগীরা নয়, হাইব্রিডরাই নেতা বনে যান। সেভাবেই গড়ে উঠছে ‘ভাই লীগ আর এমপি লীগে’র বলয়। সেই ক্ষেত্রে দল নয়, ব্যক্তি স্বার্থকে দিচ্ছেন প্রাধান্য। অভিযোগ আছে ক্ষমতার দাপটে নিজেদের আখের গোছাতেই ব্যস্ত কতিপয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি।
দেখা গেছে, নির্বাচনী এলাকায় এমপিদের সাথে তৃণমূলের দূরত্ব, গ্রুপিং, কোন্দল, বিভেদ নিত্যদিনের। প্রতিপক্ষের দলীয় প্রার্থী ও সমর্থকদের সঙ্গেও প্রতিনিয়ত চলছে বিরোধ। যা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, উপজেলা পরিষদ নির্বাচন, ও সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে দেখা গেছে। সেই নির্বাচনে ‘ভাই লীগ ও এমপি লীগে’র প্রভাবটাও স্পষ্ট প্রকাশ পেয়েছিল বিদ্রোহীদের ক্ষেত্রে।
দেখা গেছে, একই দলের দুই লীগের কারণে মাঝেমধ্যে বিরোধ থেকে সংঘর্ষ হয়। কোনো এলাকায় আবার এমপি লীগ একচেটিয়া রাজত্ব চালাচ্ছেন। প্রতিপক্ষ এলাকাছাড়া। অধিকাংশ নেতাকর্মী অমুক ও তমুক নেতার অনুসারী হওয়াতে সংঘাতে জড়িয়ে রক্তক্ষয়ী ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। ‘এমপি লীগের পাশাপাশি রয়েছে ভাই লীগ’। ভাই লীগের খাই খাই রাজনীতিতে অতিষ্ঠ দেশবাসী। কোনো কোনো এলাকায় এসব ভাই লীগের কর্মী ও ক্যাডাররা এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ অপরাধের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তবে এবার সেই বলয় ভাঙতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, দল ও সরকারের অগ্রযাত্রা সমুন্নত রাখতে অবিলম্বে এসব ‘এমপি লীগ ও ভাই লীগে’র কবল থেকে আওয়ামী লীগকে বাঁচাতে হবে।
এ প্রসঙ্গে কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক আইন বিষয়ক সম্পাদক এডভোকেট সৈয়দ তানভীর আহমেদ ফয়সাল বলেন, আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ের ‘ভাই লীগ ও এমপি লীগ’ বলয় রয়েছে। সৃষ্ট এসব বলয় ভাঙার জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। এজন্য তৃণমূল পর্যায়ের দলের ত্যাগী, পরীক্ষিত ও পরিশ্রমী নেতাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। তিনি আরো বলেন, আওয়ামী লীগ বড় একটি রাজনৈতিক দল। মাটি ও মানুষের দল। এ দলের রাজনীতির সাথে দেশের য়য়ক সব শ্রেণি-পেশার মানুষ যুক্ত আছেন।
এখানে ভালো খারাপ দুই শ্রেণির মানুষ আসতেই পারে। কিন্তু তাৎক্ষণিক ভাবে এটা যাচাই-বাছাই করা কী সম্ভব? তাই যাচাই-বাছাই করতে একটু সময় লাগবেই। এ বিষয়ে আমাদের সভানেত্রীর কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন। আওয়ামী লীগকে হাইব্রিড মুক্ত করার মাধ্যমে তৃণমূলে সৃষ্ট ‘ভাই লীগ ও এমপি লীগ’ ভাঙা হচ্ছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে হলে বাংলাদেশ থেকে সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও মাদকমুক্ত করাই আওয়ামী লীগের নতুন কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
এ জেলার আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম সরকার বলেন, আমরা যারা বিভিন্ন জেলায় সাংগঠনিক দায়িত্ব পেয়েছিলাম তাদের একটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে নেত্রীর আকাক্সক্ষা অনুযায়ী তৃণমূলকে ঢেলে সাজানো। তারা উন্নয়নের কর্মযজ্ঞ শুরু করেছেন তা তৃণমূল পর্যায়ে মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া হবে। তবে নিজেকে এখন আর আওয়ামীলীগ করি তা পরিচয় দিতে পারছিনা।
তিনি বলেন, সরকারের পাশাপাশি দলকে শক্তিশালী করে সরকারের উন্নয়নের যে মহাযজ্ঞ সংগঠনের কোন দায়িত্বে না থেকেও তা গ্রামের মানুষের কাছে দলের মাধ্যমে পৌঁছে দেয়াই হচ্ছে আমাদের দায়িত্ব। বঞ্চিত নেতাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। কি করে সাংগঠনিকভাবে সংগঠন পরিচালনা করা যায়, তৃণমূলকে আরো শক্তিশালী করা যায় এবং তৃণমূল পর্যায় থেকে আমরা সংগঠনকে আরো ঢেলে সাজাতে পারি তা নিয়ে আলোচনাও হয়েছে।
Leave a Reply