মোহাম্মদ শরিফুল আলম চৌধুরী: ঢাকা থেকে আড়াইশ কিলোমিটারের বেশি দূরত্বের একটি আসনে (গাইবান্ধা-৫) উপনির্বাচনে বুধবার ( ৪ জানুয়ারি) ৭৮ হাজার ২৮৫ ভোট পেয়ে জাতীয় পার্টির লাঙলকে (৪৪ হাজার ৭৫২) হারিয়ে আওয়ামী লীগের যে প্রার্থী জয়ী হয়েছেন, তার গল্প শুনলে চরম হতাশায় ডুবে থাকা মানুষটিও নতুনভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস খুঁজে পাবেন।
এই মাহমুদ হাসান রিপন ১৬ বছর ৯ মাস আগে যখন ছাত্রলীগের সভাপতি হন, তখনো তাকে ঘিরে তৈরি হয় নাটকীয়তা।
সংগঠনটির ইতিহাসে সেবার দ্বিতীয় বারের মতো ভোটের মাধ্যমে সভাপতি হন তিনি। সেই নির্বাচন মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হলেও কয়েক জন কর্মীর বিতর্কিত কাণ্ডে ফল ঘোষণা একদিন পিছিয়ে বুধবারে চলে যায়! এবার সংসদ সদস্য হওয়ার পথে রিপন যে দুবার অগ্নিপরীক্ষা দিলেন, তাও সেই বুধবার। সবচেয়ে বড় কথা ছাত্রলীগের রিপন সংসদ সদস্য হলেন ছাত্রলীগেরই প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে! ৪ জানুয়ারি।
জাতীয় পার্টির দুর্গে মাহমুদ হাসান রিপন এই বয়সে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পাবেন কি না, সেটি নিয়ে যখন তুমুল আলোচনা; তখন শেখ হাসিনা তার ওপরেই ভরসা রাখেন। ১২ অক্টোবরের বুধবার প্রথম দফার নির্বাচন কয়েক ঘণ্টা পেরোতেই সিসিটিভি দেখে ভোট বন্ধ করে দেয় কমিশন।
চারদিকে তখন গেল গেল রব। এরপর শুরু হয় তদন্ত। সঙ্গে সুযোগ সন্ধানীদের নানা ষড়যন্ত্র। এমন একটি ভোটে রিপন দ্বিতীয় বারের নির্বাচনে জিতে আসতে পারবেন কি না, এই আলোচনা ছিলো খোদ আওয়ামী লীগেও। ব্যক্তি রিপনের কাছে এই লড়াই ছিলো রীতিমতো অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। এই বয়সে এই নির্বাচনে হেরে গেলে তার বহুদিনের স্বপ্ন একদম ভেসে যেত। কারণ ২০২৪ সালে জাতীয় নির্বাচনে তখন অন্য কেউ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নমিনেশন চেয়ে বসতেন।
এই রিপন ওয়ান ইলেভেনের সময় শেখ হাসিনার মুক্তির আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। এরপর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ হিসেবে নিজেকে পরিচিত করান। লোভ-লালসা দূরে রেখে নিজ এলাকা গাইবান্ধার সংসদ সদস্য হওয়ার স্বপ্ন দেখতে থাকেন। কিন্তু আসনটিতে আওয়ামী লীগের প্রতাপশালী রাজনীতিবিদ ফজলে রাব্বি মিয়া সংসদ সদস্য থাকায় রিপনের অপেক্ষা বাড়তেই থাকে। ফজলে রাব্বি যখন পৃথিবী থেকে বিদায় নেন, তখন তার কন্যা বুবলি আবার প্রার্থী হয়ে বসেন। কিন্তু শেখ হাসিনা মাঠের রাজনীতি করে আসা রিপনেই ভরসা রাখেন। শেষ পর্যন্ত বিপত্তি বাধে নির্বাচন কমিশনের বহুল আলোচিত এক সিদ্ধান্তে। সিসিটিভি দেখে ১২ অক্টোবর গোটা নির্বাচনই বাতিল করে দেয় কমিশন! এরপর ৪ জানুয়ারি এই বুধবার আবার সেই ভোট হলো।
রিপন এমন এক সময়ে ছাত্রলীগের দায়িত্ব পান, যখন আওয়ামী লীগ টালমাটাল সময় পার করছিলো। একদিকে সরকারি দলের চাপ অন্যদিকে জঙ্গিবাদের উত্থান। যে এপ্রিলে রিপন সভাপতি হন, তখনো দেশের একটি ব্যাংকের বিরুদ্ধে তরুণ জঙ্গিদের অর্থায়নের অভিযোগ ওঠে। বাংলাদেশ ব্যাংক অভিযোগের প্রমাণ পাওয়ায় ব্যাংকটিকে ১ লাখ টাকা জরিমানা করে। তরুণদের ঘিরে একটি পক্ষ যখন এমন অমানিশা সাজাচ্ছে, তখন ভোটের মাধ্যমে ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতা নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী এবং বর্তমানের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ওই ভোটে সভাপতি পদে ১৩ যুবক প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ২০০৬ সালের সেই ৪ এপ্রিল মঙ্গলবার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে ভোট হলেও ফলাফল ঘোষণা করা হয় বুধবার। সুধা সদন থেকে ভোটের বাক্স সকালে নেওয়া হয় ধানমন্ডির কার্যালয়ে। নির্বাচন কমিশনার বলরাম পোদ্দার যখন রিপনের নাম ঘোষণা করেন, তখন ঢাকার আকাশে গোধূলির ছায়া।
রিপন এবার এমন একটি নির্বাচনে জিতলেন, যেখানে নিজের অস্তিত্ব তো রক্ষা করলেনই, দলের মুখও প্রচন্ড অহংকারে রাঙিয়ে দিলেন। শতভাগ সুষ্ঠু ভোটেও আওয়ামী লীগ কীভাবে বড় ব্যবধানে জিততে পারে গোটা দেশে ছড়িয়ে দিলেন সেই বারতা।
রিপনের জয়ে শতশত নেতাকর্মী এটা ভেবে আশায় বুক বাঁধবেন যে সততা কখনো হারে না। তারা এই গল্প থেকে জেনে যাবেন, সত্যিকারের লড়াই হলে সব যোদ্ধা পড়ে থাকে মাটিতে, সিংহাসন যার পায়ে লুটায় তার স্থায়ীত্ব হয় দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর।
Leave a Reply